পাহাড় আর উপত্যকার উঁচুতে ভেসে বেড়ানো মেঘ, নদীর ধারে বৃক্ষ সারির নীচে মৃদু হাওয়ায় দোল খাওয়া ঘাস ফুল, ছায়াপথের মাঝে উজ্জ্বল ঝিকিমিকি তারার খেলা, চোখ মেললেই সবুজের মেলা, এ সব আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের দেশটির ফেলে আশা সোনালি অতীত সমানভাবে গর্ব করার মত, নিজেদের অতীত সময়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চাকে জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি স্থান, তা কুমিল্লার ময়নামতি। ঢাকা থেকে অতি সহজেই বাসযোগে অথবা ট্রেনযোগে আমরা পৌঁছে যেতে পারি কুমিল্লা । কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কোটবাড়ি বা ময়নামতি অবস্থিত। তবে শুধু বৌদ্ধ সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট পেরিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে ৫ কিলোমিটার সামনে গিয়ে ডানদিকে ৩ কিলোমিটার গেলেই চলবে।
এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে বৌদ্ধ বিহার বা মঠ প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।একে ভিক্ষুদের বাসস্থান,ধর্মীয় আচারাদিসম্পন্ন ও ধ্যান করার স্থান এবং বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের উল্লেখ্যযোগ্য বিহারগুলো হচ্ছে শালবন বিহার, ভাসু বিহার, সোমপুর বিহার, সীতাকোট বিহার ও দেবীকোট বিহার।
মধ্যযুগে বৌদ্ধ রাজত্বের রাজধানী ছিল এই ময়নামতি। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই অনুচ্চ পাহাড়ী এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি।কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদশনাদি এখানে অবস্থিত।শালবন বিহার, আনন্দবিহার প্রভৃতি দেশের বৃহত্তম ধ্বংসাবশেষ ময়নামতিতে অবস্থিত।এসব বৌদ্ধবিহারে প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার বহু নিদশনাদি পাওয়া গেছে।১৯৫৫ সালে এখানে যখন খনন কায শুরু হয় তখন এসব নিদেশনের সন্ধান পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ ধম ছাড়াও এখানে জৈন ও হিন্দু দেবদেবীর মূতিও পাওয়া গেছে।এছাড়া এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্মতাত্ত্বিক নিদশন সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘরও স্থাপিত হয়েছে। বতমানে ময়নামতিতে একটি সেনানিবাস রয়েছে,যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের একটি যুদ্ধঘাটি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। ময়নামতি ছাড়া এটি লালমাই ও হিলটিয়া নামে পরিচিত।
শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার। এতে ৭ম-১২শ শতকের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয় যে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়।চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।
আকারে এটি চৌকো। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির।
বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে রয়েছে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গিতে দেবদেবী, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন।
বিহারের বাইরে প্রবেশ দ্বারের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি হলঘর রয়েছে। চার দিকে দেয়াল ও সামনে চারটি বিশাল গোলাকার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সে হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবার ঘর ছিল বলে ধারণা করা হয়। হলঘরের মাপ ১০ মিটার গুণন ২০ মিটার। হলঘরের চার দিকে ইটের চওড়া রাস্তা রয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে।
নিজের চোখে নিজেদের অতীত সমৃদ্ধিকে একটু অনুভব করতে ঘুরে আসুন কুমিল্লার ময়নামতি থেকে, তবে ফেরত আসার পথে পরিবারের সকলের জন্য কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই নিতে ভুলবেন না যেন। ঠিক রসমালাইয়ের মিষ্টির মত মিষ্টতায় ভরে উঠুক আপনাদের জীবন, শুভকামনা রইল ।