জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক বাঙালি জাতির এক দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার একশ বছর পর ১৮৫৮ সালে বাহাদুর শাহ পার্কে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তখন এ পার্কের নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। তবে ১৮৫৭ সালে এই পার্কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহে অন্তত ১১ জন সিপাহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বিদ্রোহের সূত্রপাত ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এ সময় সিপাহীদের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। এই রাইফেলের কার্তুজ গরু ও শূকরের চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে বলে গুজব ছাড়িয়ে পড়লে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমপ্রদায়ের সিপাহীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ মুসলমানদের কাছে শূকর অপবিত্র হিন্দুদের কাছে গরু নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত। দেশীয় সৈন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজরা এভাবে কার্তুজ তৈরি করেছে বলে সিপাহীরা ঐকমত্য পোষণ করে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। দিলি্লতে আক্রমণ চালিয়ে দিলি্ল দখল করে নেয় এবং বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে ঘোষণা করে। এদিকে ইংরেজরা বিপুল শক্তি সনি্নবেশিত করে সিপাহীদের নির্মূল ও বন্দী করে একে একে ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য এলাকা পুনরুদ্ধার করে। পূর্ববঙ্গে সিপাহীদের মূল ঘাঁটি ছিল ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। ১৮৫৭ সালের ২৬ নভেম্বর ভোরে ইংরেজ বাহিনী লে. লুইসের নেতৃত্বে অতর্কিত লালবাগ কেল্লা আক্রমণ করে। এর জবাবে সিপাহীরাও পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং পরী বিবির মাজারসংলগ্ন স্থানে স্থাপিত কামান থেকে সিপাহীরা গোলা ছুড়তে থাকে, ফলে ইংরেজ সেনাদের ভিতরে প্রবেশ ব্যাহত হয় এরপর ইংরেজ সেনারা প্রাচীর অতিক্রম করে সিপাহীদের ওপর ভয়ানক চার্জ শুরু করে। এ সময় সিপাহীরা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধে ৩১ জন সিপাহী নিহত হন। ইংরেজদের পক্ষে নিহত হয় ৫ জন এবং আহত হয় ১৪ জন। তারা ২০ জন সিপাহীকে গ্রেফতার করে। ৩০ নভেম্বর ভিক্টোরিয়া উদ্যানে ৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। এর আগে আরও ৮ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। বাকি বন্দীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া পার্কে দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী সিপাহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং উদ্যানটির নামকরণ করা হয়। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের নামানুসারে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ নামকরণ করা হয়।
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক এক সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ছোট এই পার্কটির চারপাশে রাস্তা থাকায় আপনার কাছে পার্কটিকে একটি চত্বর বলে মনে হতে পারে।
বাহাদুর শাহ পার্কের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের সময় শতশত সিপাহী এবং তাঁদের বেসামরিক সহযোগীদের এই পার্কেই জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। পরবর্তীতে ১৮৫৮ সালে সিপাহীদের স্মরনে নবাব খাজা আব্দুল গনি এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহন করেন।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত এই পার্কটির নাম পরবর্তী সময়ে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট “বাহাদুর শাহ-২” এর নামানুসারে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। তবে, এখনও অনেকেই এই পার্কটিকে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই চেনে। তাই পার্কটি সহজে খুঁজে পেতে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামটিও মনে রাখা প্রয়োজন।
কিভাবে যাবেন
স্থানীয় যেকোন বাহনে করে আপনাকে জনসন রোডে পৌছাতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চেনা থাকলে আপনার জন্য বাহাদুর শাহ পার্কটিকে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে কেননা পার্কটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই অবস্থিত।
কি করবেন
চমৎকার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারনে বাহাদুর শাহ পার্কটি ঢাকা শহরের অন্যান্য স্থানের চাইতে আলাদা। এই পার্কের অভ্যন্তরে কোন ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয় না। বেশীরভাগ মানুষ বাহাদুর শাহ পার্কে হাঁটার জন্য এসে থাকেন।