প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টগ্রামে এসে ফয়’স লেক না দেখে চলে যাওয়া যেন অনেকটা মলিন আঁধারে থাকার মতো। শুধু সমুদ্র দেখে চট্টগ্রাম ভ্রমণ শেষ করা কোন সৌন্দর্য ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য ভাল খবর নয়। ফয়স লেক প্রকৃতি এবং আধুনিকতার এক সমন্বিত রূপ। তাই এ শতাব্দিতে এসে ফয়’স লেক না দেখে চট্টগ্রাম ত্যাগ অনেকটা বিফলযাত্রা। এই লেক শুধু বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদেরই টানছে না, দূর-দুরান্তের দেশ থেকে আসা ভ্রমণবিলাসী মানুষকেও আকর্ষণ করে। ফয়’স লেক ভোরে বিকেলে দিনে কিংবা রাতে এই চার সময়ে চার রূপে ধরা দেয়। জ্যোৎস্না রাতে তারার মেলায় ফয়’স লেকে থাকে রূপালী ঢেউ। অনেকেই সেই অপরূপ জ্যোৎস্নাত দৃশ্য দেখে ঘুমহীন চোখে উপভোগ করে। তাই চট্টগ্রাম এসে ফয়’স লেকে আসবেন না, এই ধরনের ভ্রমণকারীর কথা এই যুগে চিন্তা করাও যায় না।

 

সে এক নান্দনিক সৌন্দর্যের অপরূপ প্রকৃতি। ঝরনার জলে স্নান। ঢেউয়ের তালে নাচানাচি আবার রাইডের মাতামাতি নিয়ে হ্রদ ও পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্র ফয়’স লেক। যা হাতছানি দেয় ভ্রমণপিয়াসীদের। নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ প্রকৃতির কাছে ছুটে যায় কর্মব্যস্ত মানুষ। এ বিনোদন কেন্দ্রে দিনে বেড়ানোর পাশাপাশি সুযোগ রয়েছে রাতযাপনেরও। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও সি-ওয়ার্ল্ড নিয়ে পুরো ফয়স লেক একটি বিশেষ বিনোদন কেন্দ্র।

 

একদিকে ছোট বড় অসংখ্য টিলা আর পাহাড়, অন্যদিকে নীল জলরাশি। কৃত্রিমভাবে তৈরি হলেও এখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রশান্তি এনে দেয়। থাকা, খাওয়া, স্পিডবোটে করে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থাসহ রয়েছে বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থা।

 

পাহাড়ঘেরা সবুজ বনানী আর স্বচ্ছ লেক নিয়েই জন্ম হয়েছিল ফয়’স লেক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই স্তম্ভটি  প্রকৃতিপ্রেমীদের যে কোনো সময় কাছে টানে। চট্টগামের পাহাড়তলী রেল স্টেশনের অদূরে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক ১৯২৪ সালে প্রায় ৩৩৬ একর জায়গায় নির্মিত এ কৃত্রিম হ্রদ। এই লেকটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়িভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট। ভূতাত্ত্বিকভাবে এইসব পাহাড় শ্রেণী ডুপিটিলা স্তর সমষ্টির শিলা দ্বারা গঠিত। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম শহরের ব্যাপক এলাকায় পানি সরবরাহের লক্ষে জলাধার হিসেবে এ  হ্রদ খনন করে। এ কৃত্রিম হ্রদটি ইংরেজ আমলে রেলওয়ে কারখানায় পানি সরবরাহের জন্যই মূলত এটি সৃষ্টি করা হয়। এ লেকের পরিকল্পনাকারী ছিলেন ‘মিস্টার ফয়’ নামে রেলওয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে ফয় সাহেবের নামেই লেকটির নামকরণ করা হয় ফয়’স লেক।

 

২০০৫ সালে কনকর্ডের ব্যবস্থাপনায় ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কটির যাত্রা শুরু হয়। এখানে রয়েছে ২০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের রাইড। বর্তমানে ফয়’স লেকের সাথে সঙ্গতি রেখে সেখানে কনকর্ড গড়ে তুলেছে এমিউজমেন্ট পার্ক। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সেখানে এখন রয়েছে আধুনিক মানের বিভিন্ন রাইডস। ফয়’স লেকের প্রবেশমুখেই রয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। নানা ধরণের প্রাণী রয়েছে এই চিড়িয়াখানাটিতে।

 

বর্তমানে চট্টগ্রামের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হচ্ছে ফয়’স লেক। পাহাড়তলীতে অবিস্থত পাহাড়ের পাদদেশে লেক সমৃদ্ধ বিশ্বমানের একটি ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। এই লেক দর্শনার্থীদের বিনোদনের চাহিদা পূরণ করে আসছে। রয়েছে লেক’র ওপর ঝুলন্ত সেতু, অত্যাধুনিক রাইডস, মোটেল রিসোর্টস, সী ওয়ার্ল্ড, হানিমুন শ্যালে, ক্লাব হাউস, নৌকা, প্যাডেল বোট ও ইলেকট্রিক মোটর বোট, রেস্তোরা, মার্চেন্ডাইজ, গিফ্ট শপ, অবজারভেশন টাওয়ার ইত্যাদি।

 

ফয়’স লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিনশ ফুট উঁচু এ লেকে বছরের সবসময়ই কানায় কানায় জলে পূর্ণ থাকে। চারিদিকে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে এই লেকের জলরাশি।

 

ফয়’স লেকে পৌঁছাতেই শরীরে হিমেল বাতাসের পরশ লাগে। হ্রদের পাড়ে যেতেই দেখা মিলবে সারি সারি স্পিডবোট। এখান থেকে মিনিট দশেক যেতে হবে। তারপরই দেখা মিলবে চমৎকার রিসোর্টের। সাগর-পাহাড় আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য চট্টগ্রামকে করেছে ভৌগোলিকভাবে সমৃদ্ধ। এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক ছুটে আসেন রাতযাপনের জন্য।

 

অন্যদিকে ‘ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড’ ফয়’স লেকের মাঝে অন্য আরেক ভুবন। ফয়স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের পাশে ২০০৭ সালে গড়ে ওঠে সি ওয়ার্ল্ড নামে ওয়াটার পার্ক। ক্রমেই এই ওয়াটার পার্কটি ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। ফ্যামিলি পুল, ওয়াটার ফল, পে জোন, ওয়েভপুল, স্লাইড ওয়ার্ল্ড সহ অনেক রাইড।

 

ছোট-বড় কারও যদি আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছা হয়, তাহলে উঠতে হবে ফেরিস হুইলে। এছাড়া রেড ড্রাই স্লাইড, পাইরেট শিপ, ইয়েলো ড্রাই স্লাইড ইত্যাদি রাইডে চড়া যাবে। প্যাডেল বোট নামে একটি বৈঠাবিহীন নৌকা নিয়ে (দু’জন) আঁকাবাঁকা হ্রদের ঝোপ-জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। হ্রদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘোরার জন্য রয়েছে ফ্যামিলি রোলার কোস্টার। বিনোদনপিপাসুদের জন্য পানিভিত্তিক রাইডগুলো রোমাঞ্চকর ও চমকে ভরা। একসঙ্গে দুই হাজারের বেশি লোক নামতে পারে এই ওয়াটার পার্কে।

 

প্রতিদিন পার্কটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে বেলা ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এখানে নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা চেঞ্জ রুম, আলাদা লকার, অতিরিক্ত কাপড় ও তোয়ালে ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা। এ ছাড়া রয়েছে বিশ্বমানের সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা

 

পার্কের রাইডগুলোর জন্য প্রতিজনকে খরচ করতে হবে ৩০ থেকে ৬০ টাকা। তবে ১০-১৫ জনের বড় ইঞ্জিন নৌকাগুলোর খরচ ২৫ মিনিটে ৭০০ টাকা। রাইড ছাড়া পার্কের প্রবেশমূল্য বড়দের জন্য ১৫০ টাকা। তিন ফুটের কম শিশুদের প্রবেশমূল্য না থাকলেও এর বেশি উচ্চতার শিশুদের জন্য ৭৫ টাকা।

 

আনন্দ উপভোগের জন্য সংযোজন করা হয়েছে শতাধিক রাইড। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে লেকের পাড় ধরে অরণ্যে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাটিও সঞ্চয় করা যায় এখান থেকে। ব্যাটারিচালিত বোটে চড়ে লেকের স্বছ নীল জলে পথ পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। আছে পারিবারিক বিনোদনের সব আয়োজনই। লেক এলাকার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক ক্যাবল কার।

 

নৌকায় নৌকায় ঠোকাঠুকি, পানিতে দোল খাওয়া আর আরেক নৌকার সঙ্গে ইচ্ছামত ধাক্কাধাক্কি। বাম্পার বোট নামে এ রাইডটি বেশ জনপ্রিয়। বাম্পার কার দিয়ে ঠোকাঠুকির প্রতিযোগিতা করা যায়। এর পাশ দিয়ে সার্কাস ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে চলে যায়। রঙবেরঙের ঘোড়ার ওপর বসে শিশু-কিশোর থাকে উচ্ছ্বাসে। এ রাইডের নাম বেবি কেরাওসাল। রয়েছে ভিডিও গেমসও। আর লাফালাফি-দাপাদাপির জন্য বাগ বাউন্স ও হ্যাপি জাম্প।

 

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শে ফয়’স লেক এখন বদলে গেছে। স্বচ্ছ নীল জলরাশির বুকে ইঞ্জিনের নৌকায় চড়ে সবুজ অরণ্যের শিহরণ জাগানো নীরবতা যেখানে হাতছানি দিয়ে ডাকে, সেই ফয়’স লেক এখন সত্যিই সুন্দর|

 

প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্য দুটোকেই অনায়াসে উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যাবেন ওয়াটার ওয়াল্র্ডে। দুপুর পর্যন্ত ভ্রমণ করে অনায়াসেই ওয়াটার ওয়ার্ল্ভ্রে গিয়ে কিছুটা সময় আনন্দেই কাটানো যায়। পাহাড়ের কোলে স্বচ্ছ লেক, লেকের ধারে কুটির, জলযান-সব কিছুই আকর্ষণীয়।

 

রাইড ছাড়া পার্কের প্রবেশ মূল্য বড়দের জন্য ১৫০ টাকা। পিকনিকের জন্য রয়েছে নানা অফার। পিকনিকের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। আর করপোরেটদের জন্য জনপ্রতি প্রবেশ ফি ১২০ টাকা। উভয় ক্ষেত্রে ১০০ টাকা দিয়ে সব রাইড ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যাবে।

 

ফয়স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের ফটক দিয়ে ওয়াটার পার্কে যেতে চাইলে প্রতিজনের খরচ পড়ে ৩৯০ টাকা। এক্ষেত্রে ১০ মিনিটের ইঞ্জিন নৌকা ভ্রমণের সুযোগও থাকে। আবার কর্নেল হাট বিশ্ব কলোনি ফটক দিয়ে ওয়াটার পার্কে প্রবেশ ফি ২৭০ টাকা। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও ওয়াটার পার্কে বেড়াতে এসে দুপুরের খাবার সারতে চাইলে লাগবে জনপ্রতি ন্যূনতম ২০০ টাকা। এখানে রয়েছে লেকভিউ ও রিসোর্ট নামে দুটি রেস্তোরাঁ। এছাড়া পার্কে জুস কর্নার, ফাস্টফুড, চটপটি, ফুচকা ইত্যাদির দোকান তো রয়েছেই।

 

ফয়স লেকে রাতযাপনের সুবিধাও রয়েছে। হ্রদের পাড়ে রয়েছে আধুনিক সুযোগসংবলিত রিসোর্ট। চারদিকে পাহাড় আর অরুণাময়ী, গোধূলি, আকাশমণি ও মন্দাকিনী, দক্ষিণী, অলকানন্দা হ্রদ। তারপরই দেখা মিলবে চমৎকার রিসোর্ট। হানিমুন শ্যালে, গোল্ড ও প্লাটিনাম  এ তিন ক্যাটাগরির রুম রয়েছে রিসোর্টে। রিসোর্টের ব্যালকনি থেকে উপভোগ করা যাবে স্বচ্ছ জলরাশি, সবুজ পাহাড়, হ্রদ, আকাশ, ছুটে চলা হরিণ, বুনো খরগোশসহ নানা প্রজাতির পাখি।

 

এছাড়া রয়েছে রেস্টহাউস। রেস্টহাউস ও রিসোর্টের অতিথিরা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও ওয়াটার পার্কের সব রাইড বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। ফয়’স লেক রিসোর্টে প্রতিদিন রাত যাপন দুই হাজার পাঁচশত থেকে সাত হাজার টাকা এবং রিসোর্ট বাংলোয় প্রতিদিন রাত যাপন দুই হাজার পাঁচশত থেকে ছয় হাজার টাকা। যাঁরা চট্টগ্রামে এসে ফয়’স লেকে থাকতে চান, তাঁদের ঢাকা অফিস থেকে যোগাযোগ করে ফয়’স লেক রিসোর্টে বুকিং দিয়ে আসাই ভালো। এছাড়াও আনন্দ উপভোগ করার জন্য বিশেষ দিনগুলোতে এখানে আয়োজন করা হয় আকর্ষনীয় কনসার্ট।

 

যেভাবে যাবেন : পাহাড়তলী এলাকাটি চট্টগ্রাম শহরের মাঝেই অবস্থিত। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে অটো রিক্সা কিংবা সিএনজি করে ১০ মিনিটেই চলে যেতে পারেন ফয়’স লেকে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসি-ননএসি বাস ও ট্রেনে ৪৮০-১২০০ টাকা ভাড়ায় চট্টগ্রাম পৌঁছানোর পর নগরী থেকে বাস-ট্যাক্সি-মাইক্রোবাসযোগে (২০-৩০০ টাকায়) পৌঁছানো সহজ।