বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা ঢাকার মিরপুরে স্থাপিত। এটি বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্ত্বরে জীবজন্তু প্রদর্শনের জন্য ঢাকা চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। বন্য প্রানী সংরক্ষণ, গবেষণা, শিক্ষা ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে ঢাকা চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭১ সালে হাইকোর্ট চত্ত্বর থেকে মিরপুরে চিড়িয়াখানা স্থানান্তর করা হয়। মিরপুরের তুরাগ নদীর তীরে ১৮৬.৬০ একর জায়গার উপর ঢাকা চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন। বছরে প্রায় ৩০ লাখ দর্শনার্থী ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে থাকেন। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এটির নাম পরিবর্তন করে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা নামকরণ করা হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঢাকা শহরের শাহবাগে তৎকালীন নবাবরা একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার গোড়াপত্তন করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে একটি চিড়িয়াখানার অভাব অনুভূত হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে ঢাকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে বর্তমান ঈদগাহ এলাকায় ৪-৫ একর জায়গা জুড়ে ছোট আকারের একটি চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। চিড়িয়াখানাটিতে একটি বড় পুকুর এবং পাড়ের খানিকটা জায়গা জুড়ে একটি বলাকা প্রদর্শনী ছিল। সেখানে রাজহাঁস, পাতিহাঁস, শীতের পরিযায়ী হাঁস এবং অন্যান্য পাখি ছিল। হাড়গিলা, সারস এবং ময়ূরও প্রদর্শিত হত। বানর, হনুমান আর হরিণ ছিল। সরিসৃপের মধ্যে অজগর ও কুমির ছিল প্রধান।
ঢাকায় একটি আধুনিক চিড়িয়াখানা স্থাপনের ব্যাপারে প্রথম সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন কৃষি, সহযোগিতা ও ত্রাণ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি চিড়িয়াখানা ও উদ্ভিদ উদ্যান স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সে বছর ২৬ ডিসেম্বর প্রস্তাবনাটি চুড়ান্তভাবে ঘোষিত হয়। এরপর চিড়িয়াখানা স্থাপনের কোনপ্রকার উদ্যোগ ছাড়াই এক দশক পার হয়ে যায়। ১৯৬১ সালের ১১ মার্চ খাদ্য ও কৃষি বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের বরাতে এক উপদেষ্টা পরিষদের নাম ঘোষণা করা হয়। এ পরিষদের কাজ ছিল প্রস্তাবিত চিড়িয়াখানা ও উদ্ভিদ উদ্যান স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দান। তদানীন্তন পশুপালন সার্ভিসের পরিচালক এই পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
চিড়িয়াখানা তথ্যকেন্দ্র হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ১৯১ প্রজাতির ২১৫০টি প্রাণী রয়েছে। তবে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ১৩৮ প্রজাতির ২ হাজার ৬২২টি প্রাণী ও পাখি রয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক ।
বদলে যাচ্ছে ঢাকা চিড়িয়াখানা
চিড়িয়াখানা নিয়ে মানুষের উৎসাহের যেন কমতি নেই। সৃষ্টির রূপ খোঁজার পিপাসা নিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিড়িখানায় ভিড় জমান। খাঁচায় বন্দি প্রাণীদের খুব কাছ থেকে দেখার বাসনা মানুষের স্বভাবজাত। জাতীয় চিড়িয়াখানা আধুনিকতার দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও আয়তনে বিশ্বের চতুর্থ। তবে সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তনও এসেছে বেশ। বিশ্বমানের করে তুলতে নেয়া হচ্ছে বিশেষ পরিকল্পনা।
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানার চেহারা বদলে যাচ্ছে। এটিকে বিশ্বমানের একটি আধুনিক চিড়িয়াখানা হিসেবে তৈরি করতে আমুল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এজন্য দেশি বিদেশি পরামর্শকদের সমন্বয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যানও করা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলকে দায়িত্ব দেয়া হবে। পরবর্তীতে বুয়েট টিম বিদেশি পরামর্শকদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে।
আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি মৎস ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে বুয়েটের সঙ্গে চুক্তি করবে। গত সোমবার চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার জাতীয় ও রংপুরের চিড়িয়াখানা উন্নয়নে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা রয়েছে। গত বছর এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কমিশন এই প্রকল্প অনুমোদনের আগে একটা মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়।
এই অবস্থায় মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ও বিদেশি এক্সপার্টদের পরামর্শ নেয়া হবে। এজন্য আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। চুক্তির পরবর্তী এক বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান শেষ হবে বলে তিনি জানান।
চিড়ায়াখানা কিউরেটর অফিস সূত্র জানায়, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা ফিরে পাবে বনের পরিবেশ আর দর্শকরা পাবেন উন্নত বিশ্বের আদলে ব্যতিক্রমী চিড়িয়াখানা। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম দেশের দুই সরকারি চিড়িয়াখানাকে (ঢাকা ও রংপুর) বিশ্বমানে উন্নীত করতে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
‘ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানা আধুনিকায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান চিড়িয়াখানার পরিবেশ সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ভূপ্রাকৃতিক, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রাণীবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে। নতুন এই চিড়িয়াখানায় যেমন প্রাণীদের জন্য রাখা হচ্ছে সম্পূর্ণ বন্য পরিবেশ, তেমনই দর্শকদের জন্যও থাকবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।
জানা গেছে, এই প্রকল্পে ঢাকা চিড়িয়াখানার ১৮৬ একর জমিকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হবে। ঢাকা চিড়িয়াখানার বর্তমান অবকাঠামো পরিবর্তন করে দর্শকদের জন্য একমুখী রাস্তা তৈরি করা হবে।
চিড়িয়াখানা এলাকার উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে, প্রধান ফটক এবং অন্যান্য ছোট ফটক (শিশু পার্ক), সুরক্ষা দেয়াল, দিক নির্দেশক, সব শ্রেণির মানুষের সহজে যাতায়াতের জন্য সিড়ি, দর্শকদের জন্য বসার ব্যবস্থা (ফুটপাত এবং পার্কে ছাউনি এবং ছাউনি ছাড়া), রেলিং, সড়ক দ্বীপ, রোড ডিভাইডার ও বিভিন্ন গাছের পাত্র, রাস্তায় এবং বাগানে আলোর ব্যবস্থা, ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, দর্শকদের জন্য আলাদা রাস্তা (একমুখী) এবং দেয়াল ও বনায়ন (ভূপ্রাকৃতিক)।
তথ্যমতে, চিড়িয়াখানার পশু-পাখির খাঁচাকে সম্পূর্ণভাবে বন্য আবহে তৈরি করতে একজন জাপানি জু-আর্কিটেকচার এবং একজন জু-কনসালটেন্টের সহায়তা নেয়া হবে। প্রচলিত পদ্ধতির প্রাণী খাঁচাকে বদলে আধা প্রাকৃতিক, প্রাণীবান্ধব ও তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় বিশিষ্ট খাঁচা তৈরি করা হবে।
দর্শকদের জন্য খাঁচার নিরাপত্তায় স্টিল গ্রিলের সঙ্গে বিশেষায়িত কাচের আবরণ ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও ব্যবহার হবে লোহার জাল। বিশেষ কাচের দেয়াল থাকায় দর্শকরা সবচেয়ে কাছ থেকে প্রাণীদের দেখতে পারবে। প্রত্যেক প্রাণীর নিজস্ব আবাসস্থলের মত পরিবেশ তৈরি করতে খাঁচার ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে স্ব-নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা।
এছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঢাকা চিড়িয়াখানায় বসানো হবে দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের দশটি ম্যুরাল।
চিড়িয়াখানার কিউরেটরের দফতর, একটি প্রধান এবং চারটি নিরাপত্তা অফিস, প্রাণী হাসপাতাল ছাড়াও কর্মকর্তাদের জন্য নতুন একটি অফিসার্স কোয়ার্টারও তৈরি করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়।
সাপ্তাহিক বন্ধ:-
অক্টোবর থেকে এপ্রিল সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার (তবে অন্য কোন সরকারি ছুটি থাকলে খোলা থাকে) সোমবার – শনিবার সকাল ৮.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.০০ টা পর্যন্ত ।
মে থেকে সেপ্টেম্বরঃ-সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার (তবে অন্য কোন সরকারি ছুটি থাকলে খোলা থাকে) সোমবার – শনিবার সকাল ৯.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.০০ টা পর্যন্ত ।
প্রবেশ মূল্য:-জনপ্রতি ১০ টাকা। আগে আবেদন করলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফরের জন্য ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয় (এতিম ও শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০০% ছাড়)